বাংলা রূপক সাংকেতিক নাটকে রবীন্দ্রনাথের অবদান

বাংলা রূপক সাংকেতিক নাটকে রবীন্দ্রনাথের অবদান।

বাংলা রূপক সাংকেতিক নাটকে রবীন্দ্রনাথের অবদান


 * ভূমিকা

 ঐশ্বৰ্য্যদীপ্ত রবীন্দ্র প্রতিভার বিচিত্র সৃষ্টি শুধু ভারতেই নয় বিশ্বের সারস্বত । সমাজের কাছেও এক চরম বিস্ময় ও পরমসম্পদ । রবীন্দ্রনাথ যে বিচিত্র ধরণের নাটক । রচনা করেছেন তার মধ্যে অন্যতম রুপক সাংকেতিক নাটকগুলি তার প্রতিভার চূড়ান্ত স্বাক্ষর বহন করে । এই শ্রেণির নাটকে তিনি সামাজিক , রাষ্ট্রিক , মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বকথার ।

 বাহনরূপে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন । মানুষের আভ্যন্তর সত্তায় এমন অনেক বক্তব্য থাকে যা আভাসেইঙ্গিতে ব্যবহার করতে হয় । রূপক - সাংকেতিকনাটকেরবীন্দ্রনাথ তাই করেছেন । রবীন্দ্রনাথের রূপক সাংকেতিক নাটকগুলি নিম্নরুপঃ ১ ) শারদোৎসব ' ( ১৯০৮ ) , ( ২ ) রাজা ' ( ১৯১০ ) , ( ৩ ) অচলায়তন ' ( ১৯১২ ) , ( ৪ ) ডাকঘর ' ( ১৯১২ ) , ( ৫ ) ফালুনী ' ( ১৯১৬ ) , ( ৬ ) রক্তকরবী ' ( ১৯১৬ ) ( ৭ ) মুক্তধারা ' ( ১৯২৫ ) , ( ৮ ) কালের যাত্রা ' ( ১৯৩২ ) । শারদ উৎসব ’ মূলতঃ ঋতু উৎসবের নাটক । শারদ প্রকৃতির শ্যামল সৌন্দৰ্য্যই এই উৎসবের প্রাণ ।


 এই নাটকেই আমরা সর্বপ্রথম ঠাকুরদা চরিত্র পাই , যা রবীন্দ্র তত্ত্ব নাটকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে বারে বারে দেখা দিয়েছে । রাজা’থেকেই রবীন্দ্রনাথের যথার্থ সাংকেতিক নাটকের শুরু।এই নাটকের কাহিনী । বৌদ্ধ জাতক থেকে নেওয়া হয়েছে । এখানে প্রতীকের মাধ্যমে ঈশ্বর উপলব্ধির কথা বলা । হয়েছে । মানবাত্মার প্রতীক রাণী সুদর্শনা রূপের মাধ্যমে অরূপ এবং ঈশ্বররূপী রাজাকে দেখতে উৎসুক । কিন্তু রূপের জগতে সে তাকে পায়নি । তাকে পেয়েছে ভক্তির মাধ্যমে আর ঠাকুরদা পেয়েছেন জ্ঞানের আলােকে ।

🔥 বাংলার উৎসব রচনা


 এ নাটকে রাজা একাধারে স্নিগ্ধ ও কৃয় । তার পতাকায় অঙ্কিত হয়েছে পদ্মফুলের মাঝখানে ব্ৰজপদ্ম সৌন্দর্য্যের ও বজ্ৰ ভয়ংকরের 


অচল আয়তন প্রাচীন কালের মন্ত্র ও তন্ত্রের পটভূমিকায় রচিত । এতে প্রথা ও সংস্কারের চাপে মানবাত্মার স্বাধীন প্রকাশের বিলােপ ও তা থেকে মুক্তি লাভের কথা ঘােষিত হয়েছে । আচার বিচার , জপ - তপ , মন্ত্র - তন্ত্র যখন অচল অবরােধ সৃষ্টি করে তখনই গুরুর আবির্ভাব হয় । 


আর ঠিক তখনই অচল আয়তনের প্রাচীর ভেঙে মানবাত্মার যাবতীয় পীড়নের অবসান ঘটে । ডাকঘর ’ নাটকটি রবীন্দ্রনাথেরঅন্যতম শ্রেষ্ঠনাটক । স্বদেশেও বিদেশে সর্বাপেক্ষা অধিকজনপ্রিয় ও অভিনীত । এই নাটকেরভাববস্তু বড় চমৎকার । অমল হল মানবআত্মার প্রতীক । সে জীবন ব্যাধি জর্জরিত সমাজ সংস্কারের উর্ধগতিকে রােধ করতে চায় ।


 সমস্ত বাধাবন্ধন ছিন্ন করে ছেড়ে যেতে ব্যাকুল । হঠাৎ সে দেখল রাজার ডাকঘর বসেছে । তখন সে ভাবল রাজা বুঝি তার নামেও একটি চিঠি পাঠাবেন । তখন তার মনের ব্যাকুলতা গেল কমে এবং ঘরের মধ্যেই তার ভাল লাগল । সুদূর ও অসীমকে যখন সীমা থেকে পৃথক করে দেখা হয় , তখন পরম সত্যকে পুরােপুরি পাওয়া যায় না । সীমা ও অসীমের নিদ্বন্দ্ব ।

 সাধনাই রবীন্দ্রনাথের জীবন সাধনা — সে কথা অমলের প্রতীকের মাধ্যমে বলা হয়েছে । অমলের সুখ হল মর্ত্যজীবন থেকে তার পরিত্রাণের কাহিনী , মুক্ত মানবাত্মা অসীমের সঙ্গে মিশে গেল । ফাল্গুনী ’ নাটকেজীবন - মৃত্যু , শীতবসন্ত , জরাও যৌবনের দ্বৈত সত্ত্বার পারস্পরিক সম্পর্কের পটভূমিকায় এক নতুন ঋতুনাট্যের পরিকল্পনা আছে । একদল তরুণ পণ করেছিল । গুহার মধ্যে আত্মগােপনকারী বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে আসবে । যখন ধরে নিয়ে এল তখন দেখা গেল এই বৃধতাদেরই সর্দার । 


আসলে জরা - মৃত্যু কিছুই নয় — এ হচ্ছে যৌবনের প্রতীক । বসন্তের প্রতীক , পূর্ণতার প্রতীক । বাইরে থেকে বা দূর থেকে দেখলে তাকে জরা বৃদ্ধ বলে মনে হয় । আসলে সে যৌবনেরই প্রতীক । এই তত্ত্বটিই ফাল্গুনী ’ নাটকে ধরা পড়েছে । রক্তকরবী ’ এক অসাধারণ প্রতীক নাটক । এতে বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার রুদ্ধশ্বাস মানব জীবন এবং লােভের ফলে মানুষের মরণ ফাঁসের নিদারুণ স্বরূপ অদ্ভুত প্রতীক ও রহস্যময় ব্যঞ্জনার দ্বারা আভাসিত হয়েছে ।


 এই নাটকে আধুনিক জীবনের একটি অভিশপ্ত দিকেরকথা যেমন বলা হয়েছে , তেমনি সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনার দ্বারা রক্তকরবীর সাহায্যে অপরাজেয় প্রেম ও প্রাণের জয় ঘােষণা করা হয়েছে । নাটকে রঞ্জনের চরিত্রটি যৌবনের প্রতীক । আধুনিক জীবনের শক্তি ও ঐশ্বর্যের প্রতীক হচ্ছে যজ্ঞরাজ এবং নন্দিনী শস্য সুন্দর শ্যাম বসুন্ধরার প্রতীক । এই নাটকে প্রতীকের ব্যঞ্জনা , নাটকীয়তা ও গীতি রসের দ্বারা রূপক সাংকেতিকতত্ত্ব দানা বেঁধেছে । মুক্তধারা আধুনিক জীবনের রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার পটভূমিকায় রচিত । যয়ের চেয়ে মানুষ লড় ।


 এক এই নাটকে গিটি হয়েছে । এই নাটকে অভিজিৎ চরিত্রটি যন্ত্র দানবের বিরুখে লড়াই করে প্রমাণ করতে চায় সে শহী ।


 মানুষের প্রতীক । অন্যদিকে কান বৈরাগী চরিত্রটি মীজির অহিংসা নাতির অনুকরণে : অক্ষিত । এই নাটকে তত্ত্বের সঙ্গে ঘটনা বলে নাট্যধর্মও স্বীকৃত হয়েছে । এখানে যাত্রাজ্যবাদী । ও যন্ত্রশক্তির বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে । " ‘ কালের যাত্রী ' নামক ক্ষুদ্র নাটকে তত্ত্বকথা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বলে এর নাট্য |


 নি লক্ষণ বড় কম । এই নাটকেৱথ হচ্ছে মানব সমাজের গতির প্রতীক । এতকাল বিভিন্ন যুণে ব্রায়ণ , ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরা রথের রশি ধরে সে রথ চালনা করেছে । বর্তমান যুগে শুদ্র অর্থাৎ , ৩ শ্রমিকরাই আমাদের অন্ন - বস্ত্র দাতা । রথের রশি তাই আজ তাদেরই হাতে । রথের দেবতা । বলতে রবীন্দ্রনাথ মহাকালকেই বুঝিয়েছেন । 


রুপক সাংকেতিক নাটকে রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য  ঃ 

রবীন্দ্রনাথের রুপক - সাংকেতিক ও নাটকগুলি একটি স্বতন্ত্র পথ ধরে এগিয়েছে । এই নাটকগুলির বিশ্লেষণে একটি প্রশ্ন বড় । ! 


হয়ে দেখা দেয়।তা হল — নাটকগুলিরূপক , না সাংকেতিক ? নাকিরুপক ও সাংকেতিকতার ৩ মিশ্রণ ? এক কথায় এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন । বলা যায় রবীন্দ্রনাথ কিছু সংকেতও । প্রতীক ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে । কিন্তু সংকেত বা প্রতীকগুলাে নাটক


 = শেষে পৌছে সংকেত বা প্রতীক হয়ে থাকেনি । সংকেতগুলাে ধীরে ধীরে রুপক পরিণামের মা দিকে অগ্রসর হয়েছে । দানা বাঁধা রহস্য অন্তিমে চির জ্যোতির্ময় সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে । নাটকের প্রথমে যে অপূর্ণতা , বিনষ্টি , শঙ্কা ও ব্যর্থতা তা জীবন প্রত্যয়ে আস্তিক্যবাদী  হয়েছে । আসলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঔপনিবেশিক আনন্দে বিশ্বাসী । তিনি অধ্যাত্মবাদী কবি । তি সাধক । পরম প্রাপ্তির ভাবরসে তাই তার নাটক শেষ হয় । রহস্য দুরীভূত হয় । যেমন- রক্ত । করবী’নাটক । 


এই নাটকে বহুপ্রতীক , বহুসংকেত রহস্যময় বাতাবরণ তৈরী করে আমাদের এক অতি ভয়ঙ্কর জগতের দিকে টেনে নিয়ে যায় । কিন্তু এই নাটকের শেষে দেখি , রাজা । নন্দিনী নেমে এসেছে একই সঙ্গে পথে । তাদের ব্যবধান ঘুচে পথ এক হয়ে গেছে । শােষক - শােযিতের কোনাে ব্যবধান থাকেনি । যক্ষপুরী ভেঙ্গেচুরে গেছে । রাজা নিজেকে । 




** নিজেই ভেঙ্গেছেন । এই নাটকের প্রতিটি চরিত্রের সংলাপই এক একটি সংলাপ । কিন্তু সে নাটক শেষেসংকেতের অর্থ বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।তার সংকেতিক নাটকরুপে | জা ৷ ধর্মেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় । মূল্যায়নঃ বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই রূপক সাংকেতিকও প্রতীকধর্মী নাটকের সর্বপ্রথম ও শ্রেষ্ঠ রূপকার । তার পূর্বে এ জাতীয় নাটক আর কেউ রচনা করেন নি । সুতরাং ঐশ্বৰ্য্যদীপ্তি | জীন প্রতিভার সৃষ্টি সম্ভারে রবীন্দ্রনাথের তন্তু নাটক আজও এক গরিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে । যাভ


Post a Comment

0 Comments