মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মানবতাবাদ

 মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মানবতাবাদ 


ভূমিকাঃ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন , “ সাহিত্যের বিষয় হল মানব চরিত্র এবং মানব হৃদয় বাস্তবিকই , কোনাে সাহিত্যই সমাজ নিরপেক্ষ নয় । প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে যেখানে সমাজের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায় । তাই বলা হয় সাহিত্য সমাজের দর্পণ।বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগ বলতে মূলত মঙ্গলকাব্যের যুগকেই বােঝানাে হয় । এযুগের সাহিত্য প্রধানত দেব নির্ভর , শুধু বাংলা সাহিত্য কেন , পৃথিবীর যে কোনাে সাহিত্যেরই প্রাথমিক স্ফুরণ ঘটেছে ধর্মকে অবলম্বন করে । তবে একথা বলা যাবে না যে , ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্যে মানুষ অনুপস্থিত । আমাদের মঙ্গলকাব্যের কাহিনি দেব নির্ভর হলেও তার চরিত্রগুলি রূপায়ণে কবিরা মানবচরিত্রের প্রতিফলন দেখিয়েছেন । স্বর্গের দেব দেবীরা মত পৃথিবীতে নেমে এসেছে মানুষরুপেই । তাই তাদের জীবন চর্চায় সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ হাসি কান্না সংঘাত প্রতিফলিত । মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেগুলিতে দেব চরিত্রের আড়ালে মানবতাবাদ বাণী রূপ লাভ করেছে ।


 মনসামঙ্গলঃ মঙ্গলকাব্যের শক্তিমাহাত্ম প্রচারিত হয়েছে । এই কাব্যের বহিরঙ্গ দিক পৌরাণিক । কিন্তু একটু সূক্ষ্মভাবে উপলব্ধি করলে বােঝা যায় এর পটভূমি মানবিক মানুষের পৃথিবীতে দেবতার পরিভ্রমণ হলেও তাদের আচরণ একান্তই মর্ত মানুষে মতাে । মঙ্গলকাব্যের মধ্যেই সমকালীন যুগ সমস্যাগুলি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে প্রতিফলি । হয়েছে । আবার , মঙ্গলকাব্যের উৎপত্তির পিছনেও আছে সমকালীন সামাজিক সমসা | মধ্যযুগের প্রতিকুল সামাজিক অবস্থায় সেদিনের অসহায় সাধারণ মানুষ আশ্রয় নিয়ে বাধ্য হয়েছিল অলৌকিক কোনাে শক্তির কাছে । এই আশ্রয় নেওয়াকে কেন্দ্র করেই স্বর্ণে দেবদেবীরা স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিলেন মর্তের মাটিতে আর তাদের নামিয়ে এনে মর্তের মানুষ মনসামঙ্গল , চন্ডীমঙ্গল , ধর্মমঙ্গল প্রভৃতি কাব্যে দেব চরিত্রের দিয়ে মর্তমানুষের আশা আকাঙ্খই প্রতিফলিত হয়েছে । মনসামঙ্গল কাব্যে চাদ সদাগ পরিবারটি একান্তভাবেইসামাজিক । বাংলারবণিক পরিবারের বিশ্বস্তচিত্র এখানে প্রতি হয়েছে । বেহুলার পতি ভক্তি , সনকার বাৎসল্য , চাঁদসদাগরের দীপ্ত পৌরুষসবইমান গুণে ভূষিত । দেবী মানসার সঙ্গে চাদের সংগ্রাম মর্ত মানুষের জীবন যুদ্ধকেই সূচিত করে । দৃঢ়তা এবং আত্ম প্রত্যয় মানুষকে জীবনযুদ্ধে জয়ীকরে , চাদ সেই প্রত্যয়ে বলীয়ান । তৎকালীন সামাজিক অবস্থায় সাধারণ মানুষের অসহয়তা এই কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে ।


 চন্ডীমঙ্গল : কবি কঙ্কণ মুকুন্দরামের কাব্যেও মানবতাবাদের প্রতিফলন লক্ষ্য করা । যায় । এখানে দেবচরিত্রগুলি মানব চরিত্রের আদলে নির্মিত । হর - পার্বতীর সংসার তাে বাঙালির গৃহস্ত্যজীবনের প্রতিফলন । কালকেতু - ফুল্লরার জীবনে দুঃখ দারিদ্র সম্বল হলেও তার মধ্যে রয়েছে অপরিমেয় মানবরস । মঙ্গলকাব্য রচনা করতে গিয়ে কবি এখানে বঙ্গজীবনের কাহিনি বর্ণনা করেছেন । এ কাহিনি পাঠ করলে কখনােই মনে হয় না তা সম্পূর্ণ দেব নির্ভর । আসলে , মঙ্গলকাব্যগুলি হল একরাশ সূর্যমুখী ফুল ; তার পাপড়ি উর্ধ্বমুখী হলেও শিকড় কিন্তু বাংলার মাটিতে।তাই চন্ডীমঙ্গলে - র - সর্বাংশ জুড়ে বাংলার রাষ্ট্রনৈতিক সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় । মানুষ ছাড়া সেখানে আর কেউ প্রাধান্য লাভকরেনি।নিদয়ার সাধভক্ষণ , ফুল্লরারবারােমাস্যা , হর - পার্বতীর কোন্দল , পশুগণের ক্রন্দন সবই অফুরন্ত মানবরসেসমৃদ্ধ । বাস্তববাদী মুকুন্দরাম বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চন্ডীমঙ্গল কাব্যকে স্থাপন করেছেন সম্পূর্ণ মানবতাবাদের ওপর । 


ধর্মমঙ্গল : অনুরূপভাবে , ধর্মমঙ্গল কাব্যেও সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে । সেখানে লাউসেনের মধ্যে সমকালীন মানুষের খন্ডিত সীমাবদ্ধ শক্তি সামর্থ লিপিবদ্ধ হয়েছে । দেব মহিমা অপেক্ষা মানব মহিমাই সেখানে বড়াে হয়ে উঠেছে । আসলে , কবিরা মানুষকে দেবতার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে তাদের সংগ্রামী মহিমাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন । নিছক দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণনার উদ্দেশ্যে কাব্য গুলি রচিত হয়েছে ।


 মানুষের জয়গান : এই মঙ্গলকাব্য ত্রয় ব্যতীত অন্যান্য মঙ্গল কাব্যেও মানবিক আবহাওয়ার প্রকাশ ঘটেছে । শ্রীকৃয়কীর্তণ’কাব্য থেকে শুরু করে ভারত চন্দ্রের অন্নদামঙ্গল ’ পর্যন্ত সর্বত্রই মানুষেরই প্রাধান্য । এর একমাত্র উদাহরণ পদাবলীর চন্ডীদাস । মানবতাবাদের যে বিজয় নিশান উড়িয়েছিলেন , তা বহুযুগ অতিক্রম করেও স্ব মহিমায় উজ্জীন । তাঁর ঘােষণা


 শুনহ মানুষ ভাই 

সবার উপরে মানুষ সত্য 

তাহার ওপরে নাই । 


খুব সচেতনভাবেই তিনি মানবতাবাদের প্রচারে মনােনিবেশ করেছেন । রাধাকৃষ্ণুের তত্ত্বের সঙ্গে মানব মহিমাকে মিশিয়ে তিনি অন্য এক পদাবলী রচনা করেছিলেন । সেই জন্য রাধার বিরহ মর্ত মানুষের চোখেও জল আনে । 


উপসংহার : মধ্যযুগের আরেক উল্লেখযােগ্য নিদর্শন হল অনুবাদ সাহিত্য । মূলত , সংস্কৃত কাব্য পুরাণ থেকে বাংলার কবিরা অনুবাদকর্ম সম্পাদন করেন । তথাপি , একথা অনস্বীকার্য যে , এই অনুবাদ গুলি আক্ষরিক অনুবাদ না হয়ে , হয়ে উঠেছে ভাবানুবাদ । এই সূত্রে সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের কথা স্থান পেয়েছে । কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের কাব্য । দেবতারামচন্দ্র এখানে নরচন্দ্রমা । সীতা সর্বংসহা বাঙালি গৃহবধূ । লব - কুশের কান্নাকে মনে হয় বাংলার মাতৃহারা দুই শিশুর আর্তনাদ । দেবতা এখানে মানুষ । হয়ে মাটির পৃথিবীতে নেমে এসে মর্ত মানুষের সুখ - দুঃখেরভাগীদার হয়েছে । অনুরূপভাবে , মহাভারতেও ভারতের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় । সুতরাং দেববাদ পুষ্ট মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেশুধু দেবতার জয়গানই ঘােষিত হয়নি , কবিরা তার সাথে সাথে মানবতাবাদের নিশান উড়িয়েছেন ।


মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মানবতাবাদ 


Post a Comment

0 Comments