রূপক সাংকেতিক নাটক হিসেবে ডাকঘর | ডাকঘর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (PDF)
Encrypting your link and protect the link from viruses, malware, thief, etc! Made your link safe to visit.
ডাকঘর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রসঙ্গ- রূপক, সাংকেতিক নাট্যপ্রকরণ ও'ডাকঘর'
রবীন্দরনাট্যধারা তথা সামগ্রিক বাংলা রূপক- সাংকেতিক নাট্যধারায় , “ডাকঘর' অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংযোজন। অনির্বচনীয়কে রূপায়িত করার জন্য সাহিত্যিকেরা যে সকল সাহিত্যিক কৌশল ব্যবহার করেন, রূপক ও সংকেতের ব্যবহার তার অন্যতম। উপস্থাপনার উপর ভিত্তি করে, নাটককে সাধারণতঃ চারটি প্রধান উপবিভাগে বিন্যস্ত করা যায়, রিয়ালিস্টিক বা বাস্তবতা- নির্ভর নাটক, রোমান্টিক নাটক, আ্যালিগোরিক্যাল বা রূপক - নির্ভর নাটক, সিম্বলিক বা প্রতীক নাটক।
allegory বা রূপক এর অর্থ হল এক বোঝাতে অন্য কথা বলা। M.H. Abrams , A glossary of Literary Terms” গ্রন্থে allegory র সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন,- An allegory is a narrative in which the agents and action , and sometimes the setting as well , are contrived so as to make coherent sense on the literal ' or primary level of significance and also to signify a second , correlated order of agents , concepts , and events'e, অর্থাৎ রূপক নাটকে।
১) দুটি অর্থ থাকে, একটি আভ্যন্তরীণ ও অপরটি বাহ্যিক।
২) আভ্যন্তরিক কাহিনীটি কোনো গভীর অর্থকে ব্যঞ্জনা করে।
৩) এই ধরনের নাটকে কোনো বিমূর্ত ধারণাকে ব্যক্তিচরিত্রে আরোপ করা হয়।
symbol বা প্রতীক ও আর একধরনের নাটক । Symbol অর্থে উপর্যুক্ত বইয়ে বলা হয়েছে, - ' In the broadest sense a symbol is anything which signifies something : in this sense all words are symbols , সাধারণভাবে প্রতীকের দ্বারা একটা সমগ্রভাবকেই নতুন করে তুলে ধরা হয়। অনেক সময় সাংকেতিক নাটকে কোনো আধ্যাত্মিক বা অতীন্দ্রিয ভাবনাকেও তুলে ধরা হয়। যা কিছু আমাদের রূপের অতীত, দুরধিগম্য, অপরিজ্ঞাত - তাকেই প্রকাশ করার মাধ্যম হল সংকেত। সাধারণভাব সাংকেতিক নাটকে -
১) প্রতীকের সাহায্যে নিহিত ব্যঞ্জনাকে প্রকাশ করা হয়।
২) এই ধরনের নাটকে যুগপৎ সচেতন আর অবচেতন মনের ক্রিয়াশীলতা অনুভূত হয়।
৩) অধ্যাত্ম জগতের যেসব ধারণা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, সংকেতের দ্বারা তা ইঙ্গিতিত হয়।
৪) একই সংকেত বিবিধ ব্যঞ্জনায়, বিভিন্ন সাহিত্য কর্মে ব্যবহৃত হতে পারে।
“ডাকঘর' নাটকটি পাঠক বা দর্শকের মনে গভীর ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। সীমা ও অসীম, এরই যৌথতায় মানুষের দৈনন্দিন জীবন গড়ে ওঠে। রোমান্টিক ও মিস্টিক ভাবনায় আলোড়িত রবীন্দ্রনাথ, 'ডাকঘর' নাটকে মানবসত্তার এক নিয়ত অন্বেষণ ও অভিযাত্রাকে রূপায়িত করেছেন। মানুষের যে যাত্রা, যে অনুসন্ধানকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে অনুসরণ করেছেন, তা বাস্তবিক নয় ততখানি; বরং এ তার আন্তরিক যাত্রা। আবার সকল মানুষের তা অধিগম্য ও নয়, কেবল সংবেদনশীল মানুষই এ যাত্রার মর্ম উপলব্ধি করতে পারে।
ডাকঘর" নাটকের প্রতীকের ভরকেন্দ্র হল “ডাকঘর'। “ডাকঘর' বাস্তবিকই সুদূরের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম। “ডাকঘর' শব্দটি, সকলের মনেই দূরের আভাস বহন করে আনে । এই নাটকেও তাই। এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র অমল। সে এই সংসারের নৈমিত্তিকতার অচলায়তনে আবদ্ধ এক মুক্ত প্রাণ। প্রতিনিয়ত দূরের ডাক সে অনুভব করে, সংসারের বাতয়নে বসে। পরমার্থকে পাওয়ার জন্য সে আকুল। ডাকঘরের মাধ্যমেই কি আসবে তার জীবনের পরম বাঞ্চিতের বার্তা? এই নাটকের ঘটনা পরম্পরা তার পথ ধরেই এগিয়ে চলে। বাংলা উৎসব রচনা।
এই নাটকে 'ডাকঘর' হল বিপুল, বিচিত্র এই পৃথিবী তথা বিশ্বপ্রকৃতি। এই বিশ্বপ্রকৃতি, -অসীম- বিচিত্র সৌন্দর্যরসের ভিতর দিয়ে অহরহ নিজেকে প্রকাশ করেছে, মিলন সংকেত পাঠাচ্ছে মানুষের কাছে। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানবপ্রকৃতির মিলনেই মানবের সার্থকতা সাধিত হয়। তার খগ্ততার অবসান ঘটে। “ডাকঘর' নাটকের অমল, বদ্ধ মানবাত্মার প্রতীক । প্রথা, বন্ধন, শাসন - সমাজের বিবিধ অনুশাসন মানবের সজীবতা, স্বাভাবিক দৃষ্টিকে বাধিত করে। তাই সে এই অচলায়তন রূপ প্রাত্যহিকতা থেকে মুক্তি পেতে চায়। সেকারণেই, অমলের দ্বন্দ চলে সমাজের প্রথাগত ধ্যান - ধারণা অভ্যাসের সঙ্গে। সে নিজেকে নিয়োজিত করতে চায় এমন সব কাজে, সমাজ যেগুলিকে “কাজ' বলে স্বীকৃতি দেয় না। আবার সমাজ যে কাজগুলিকে মান্যতা দেয়, তার প্রতি অমলের তীব্র অনীহা লক্ষিত হয়।
এই মুক্তপ্রাণতা ও সমাজের নৈমিত্তিকতার যে ছন্দ, সেখানে অমলের জীবনের প্রত্যাশিত মুক্তি এসেছে মৃত্যুর রূপে। মৃত্যু, এই নাটকে জৈবিক কোনো পরিণতি নয়। তা, এক সংকেত। এই সমাজ কখনোই সামগ্রিকভাবে , মানুষের একক ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয় না। তাই, নিজের ভাবনাকে, দর্শনকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার শেষতম উপায় বরং দৈহিক মৃত্যুকে স্বীকার করে, আত্মিক মৃত্যু এবং সামাজিক জড়তাকে অস্বীকার। অমলের জীবনেও তাই ঘটে। মৃত্যুর মতই আর একটি “সংকেত' এখানে চিঠি। চিঠি, সুদূরের বার্তাবহ। সমাজের সব মানুষই সুদূরের আহ্বান অনুভব করে না। সংবেদনশীল মনই কেবলমাত্র তা অনুভব করতে পারে । তাই অমলেরই আকুলতা চিঠি পাওয়ার জন্য। অন্যদের কাছে তা বাতুলতামাত্র। "ডাকঘর" এ নাটকে দূরের প্রতীক বা চিহ্ন। সেই সুদূরকে যে অনুভব করতে চায়, সেই “ডাকঘর, দেখে আনন্দ ও বিস্ময় অনুভব করে। তাই এই নাটকে অমল বিস্মিত ও আনন্দিত হয় “ডাকঘর' দেখে। বাংলা উৎসব রচনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শনে অসীমের প্রতীকরূপে “রাজা' এসেছেন বারেবারেই। বিশেষতঃ “ডাকঘর”, রবীন্দ্রজীবনের যে পর্বের রচনা, সেই গীতাখ্য কাব্যরচনার সময়কালে “রাজা', 'পরম' বা marginal quality রূপে বিবেচিত হয়েছেন। “খেয়া”, গীতার্জলি প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে এই নিদর্শন মিলবে। 'ডাকঘর' নাটকের পূর্ববর্তী “রাজা” নাটকেও “রাজা” এই অর্থেই উপস্থাপিত। আগেই বলা হয়েছে 'চিঠি" এখানে দূরের বার্তাবহ। তাই অমল রাজার চিঠির জন্য অপেক্ষা করে। ডাকহর ( রূপক সংকীত নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান। ) করা ও এই সুত্রে অমলের প্রতীক্ষিত বার্তার বাহক। এরাই অমলের সীমাবদ্ধ জীবনে মুক্তির আস্বাদ বহন করে আনে। “রাজা' যদি হন অসীম, 'ডাকঘর' যদি হয় বিশ্বপ্রকৃতি; তবে ষড়খাতুই হল বিশ্বপ্রকৃতির আনন্দের বার্তাবহ, অসীমের প্রচারক। তাই এই নাটকের বাদল, শরৎ ডাকহরকরাদের প্রমুখ নামকরণ, বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই নাটকের 'ঠাকুর্দা', জীবনুক্ত পুরুষ । অমলের তআশ্রয়। “সুধা”, যেন মর্ত্য পৃথিবীর মায়া। “রাজ কবিরাজ' ও প্রতীক চরিত্র, রাজার সহচর । তিনিই অমলের ব্যাধির উপসর্ণের উপশম ঘটান।
এদের বিপ্রতীপে আছেন “কবিরাজ'। যিনি মর্তের খণ্ডভাবনায় অমলের গীড়ন বাড়িয়েই তোলেন। “মাধবদত্ত' বিষয়ী মানুষ। অমলের ভাবনার বিপরীতে তার অবস্থান। তবু তার শ্নেহ দিয়েই তিনি অমলকে এই খগ্ডলোকে বেঁধে রাখতে চান।
রবীন্দ্রনাথনিজে রূপক নাটক রূপে “ডাকঘর কে স্বীকার করেন নি। তিনি প্রিয়স্বদা দেবীকে লিখিত পত্রে জানিয়েছিলেন, - 'ডাকঘরের কোন রূপক নেই- যা ওর মানে, সেই ওর মানে'। তবু তো নাটক পাঠে কাহিনীর আদলে রূপকের আভাস যে মেলে, তা তো উপরে আলোচিত নাট্যচরিত্র গুলির বিন্যাসেই অনুমান করা যায়। বাংলা উৎসব রচনা।
কিন্তু এই নাটকের অভিপ্রায়, আমাদের বিশিষ্ট এক দর্শনের সম্মুখীন করে। আবার,এই দর্শনই নাটকের অভিপ্রায়কে সিদ্ধ করে। এই নাটকের "রাজা" ই হল সেই মৌল সংকেত। তিনি যে অসীমের প্রতীক সে কথা আগেই বলা হয়েছে। পরমাত্মার অনুভূতি তো আমাদের অন্তরে ছাড়া অপর কোথাও লাভ করা যায় না। তাই 'রাজা' কেও মঞ্চে আবির্ভূত হতে দেখা যায় না। অসীমকে আয়ত্ত করা মর্ত্যজীবনে তো কখনোই সম্ভব নয়। তাই অসীমের পিয়াসী অমলকে গীড়িত মানব রূপেই এই নাটকে পাওয়া যায়। যে গীড়ায় সে পীড়িত ,তার নাম মুমুক্ষা। সংসারবদ্ধ, হিসেবি মানুষের কাছে জাগতিক বিষয়, তার চাওয়া - পাওয়াই সব। তাই অমলের আকুতি, তাদের কাছে দুর্বোধ্য। সমাজবদ্ধ, সংসারী কবিরাজের কাছে, দূরের আকাঙ্কাই ব্যাধি।
তাই অমলকে তিনি সুদূরের আওতা থেকে, প্রকৃতির স্পন্দন থেকে - যা যা অমলকে সুদূরের কাছে নিয়ে যায়, সেই সব থেকে সরিয়ে রাখতে চান। নাটকের কাহিনী যত অগ্রসর হয়েছে ,নাট্য বিষয় ক্রমশ মূর্ত থেকে বিমূর্ত ভাবনাকে আশ্রয় করেছে। অমলের যে রুদ্ধজীবন, অসীমের সঙ্গে তার ক্রমবিযুক্তি, তাই তার ব্যাধিকে ক্রমশ জটিল করে তুলেছে। ঠাকুর্দার মুক্তজীবন ছন্দ , সুধার অকৃত্রিম মায়া, অমলকে ক্ষণিকের আনন্দের আস্বাদ দিলেও - তাকে অসীমের সমীপবর্তী করে না। তাই এই নাটকে, অমলের কাক্তিত অসীমকে, অমল পায় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তাই অমলের জন্য মৃত্যু যেন মুক্তির নামান্তর। মৃত্যু, এখানে অভাবাজ্মক কোনো অবস্থা নয়। মৃত্যু এখানে পূর্ণতার প্রতীক,অমর্তের যান। রূপক সংকীত নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনদর্শনে মৃত্যু কিন্তু এইভাবেই ব্যঞ্জিত; তুলনীয় গীতিবতান এর সংগীত,“ তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে / যতদূরে আমি ধাই / কোথা ও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু/ কোথা বিচ্ছেদ নাই।..মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ/ দুঃখ হয় হে, দুঃখের কুপ/ তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ, আপনার পানে চাই'। কিংবা,“ পথে চলে যেতে যেতে/ কোথা কোন্ খানে তোমার পরশ আসে/..সকল পথের ঘোচে চিহ্ৃ, সকল বাঁধন যবে ছিন্ন/ মৃত্যু আঘাত লাগে প্রাণে, তোমার পরশ আসে.. কখন কে জানে,।
স্বয়ং কবিই অমলের প্রতীকী ঘুম সম্পর্কে বলেছেন, - “ডাকঘরের অমল মরেছে বলে সন্দেহ যারা করে তারা অবিশ্বীসী। রাজবৈদ্যের হাতে কেউ মরে না, কবিরাজটা ওকে মারতে বসেছিল বটে'। এইসব উপলব্ধি তো যুক্তির শৃঙ্খলায় উপস্থাপিত হওয়ার নয়। এ কথা বোঝবার নয়, বাজবার। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক্ষেত্রে সংকেতের দ্বারস্থ হন।
তবে একথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, অবিমিশ্র ভাবে সংকেত নিয়েও কোনো সৃষ্টি হয় না। তাই প্রথাসিদ্ধ কাহিনী অবয়বের মধ্যেই ত্রষ্টাকে সংকেতের বীজ বপন করে দিতে হয়। সাংকেতিকতার আবহে তাহ রাপকের কাঠামোকে অবলম্বন করতেহ হয়। এই নাচকের ক্ষেত্রেও তাহ ঘটেছে। বিষয়ী মানুষ মাধব দত্তের অনাথ বালককে পোষ্য নেওয়া, তার অসুস্থতা, বন্দীত্ব, মুক্তির আকুলতা, রাজ কবিরাজের আগমন, চিঠির প্রাপ্তি - এই কাঠামোটি রূপকের। এই রূপকের অন্তরালে একটি তত্বকে লেখক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সে তত্ব সীমায়িত মানুষের অসীমের উদ্দেশ্যে অভিযাত্রার। এই যাত্রাপথের বর্ণনায় সংকেতকে প্রধান বাহন করেছেন কবি।
আলোচ্য নাটকটিকে তাই, অবিমিশ্র সাংকেতিক না বলে, রূপক - সাংকেতিক বলাই সঙ্গত।
0 Response to "রূপক সাংকেতিক নাটক হিসেবে ডাকঘর | ডাকঘর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (PDF)"
Post a Comment