উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা অলৌকিক গল্প | বাংলা অলৌকিক গল্প | অলৌকিক গল্প কর্তার সিং দুগ্গাল ।

 উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা অলৌকিক গল্প | বাংলা অলৌকিক গল্প | অলৌকিক গল্প কর্তার সিং দুগ্গাল 




অলৌকিক


_কর্তার সিং দুগ্গাল

তারপর গুরু নানক ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছলেন হাসান আব্দালের জঙ্গলে। ভয়ানক গরম পড়েছে । গনগনে রােদ । চারিদিক সুনসান । পাথরের চাঁই , ধু ধু বালি , ঝলসে যাওয়া শুকনাে গাছপালা । কোথাও একটা জনমানুষ নেই। 

'তারপর কী হল মা ? ’ আমি কৌতুহলী হয়ে উঠি ।

 ‘ গুরু নানক আত্মমগ্ন হয়ে হেঁটে যাচ্ছেন হঠাৎ শিষ্য মর্দানার জল তেষ্টা পেল । কিন্তু কোথায় জল ? গুরু বললেন ভাই মর্দানা , সবুর করাে।পরের গাঁয়ে গেলেই পাবে । কিন্তু তার কাকুতি - মিনতি শুনে গুরুনানক দুশ্চিন্তায় পড়লেন । অনেক দূর পর্যন্ত জল পাওয়া যাবে না অথচ সে বেঁকে বসলে সবাইকেই ঝক্কি পােয়াতে হবে । গুরু বােঝানাের চেষ্টা করলেন , “ দেখাে মানা , কোথাও জল নেই , খানিকক্ষণ অপেক্ষা করাে । এটাকে ভগবানের অভিপ্রায় বলেই মেনে নাও । মর্দানা তবু নড়তে রাজি নয় । সেখানেই বসে পড়ে । এগুবার আর উপায় নেই । গুরু গভীর সমস্যায় পড়লেন । মর্দানার একগুয়েমি দেখে হাসি পেলেও সেই সঙ্গে বিরক্তও হলেন । পরিস্থিতি দেখে ধ্যানে । বসলেন তিনি । চোখ খুলে দেখেন , মর্দানা তেষ্টার চোটে জল ছাড়া মাছের মতাে ছটফট করছে । সদগুরু তখন ঠোটে হাসি ফুটিয়ে বললেন , ‘ ভাই মর্দানা , এখানে পাহাড়ের চুড়ােয় বলী কান্ধারী আর কোথাও জল নেই । নামে এক দরবেশ কুটির বেঁধে থাকেন । ওঁর কাছে জল পেতে পার । এ তল্লাটে ওঁর কুয়াে ছাড়া আর কোথাও জল নেই।


‘ তারপর কী হল মা ? ’ মর্দানা জল পেল কিনা জানবার আর তর সইছিল না। 

‘ মর্দানাশুনেই ছুটে গেল । একে তেষ্টায় কাতর , তার উপর মাথায় গনগনে রােদ ঘেমে নেয়ে পাহাড়ে উঠছে । হাঁপাতে হাঁপাতে শেষ অবধি অনেক কষ্টে উঠতে পারল । বলী কান্ধারীকে সেলাম জানিয়ে জল চাইলে তিনি কুয়াের দিকে ইঙ্গিত করলেন । সেকুয়াের দিকে এগুলে অলৌকিক একটা প্রশ্ন জাগল ওর মনে । জিজ্ঞেস করলেন , কোথেকে আসছ ? মর্দানা জানায় , আমি পির । নানকের সঙ্গী । ঘুরতে ঘুরতে এদিকে এসে পড়েছি । বড্ড তেষ্টা পেয়েছে কিন্তু নীচে কোথাও জল নেই । নানকের নাম কানে যেতেই বলী রেগে গিয়ে তাকে সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দিলেন । নেমে সে নালিশ জানাল । সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে গুরু হাসেন , ‘ মর্দান তুমি আর একবার যাও । এবার নম্রভাবে বলবে , আমিনানক দরবেশের অনুচর ’ । তার ভয়ংকর তেষ্টা পেয়েছে অন্য কোথাও জল নেই । ক্ষোভে দুঃখে বিড়বিড় করতে করতে সে আবার গেল । কিন্তু বলী কান্ধারী ‘ আমিকাফেরের শিষ্যকে এক গণ্ডুষ জলও দেবনা’বলে এবারও তাড়িয়ে দিলেন । মর্দানা এবার যখন ফিরল , তখন রীতিমতাে করুণ অবস্থা । গলা শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে , দরদর করে ঘামছে । বেশিক্ষণ বাঁচবে কিনা । সন্দেহ । গুরুনানক সব শুনে মর্দানাকে ‘ জয় নিরঙ্কার’বলেওঁর কাছেআর একবার যেতে বললেন । আদেশ অমান্য করতে না পেরে সে ফের রওনা দিল । যা অবস্থা , হয়তাে পথেই প্রাণটা বেরিয়ে যাবে । তিন বারের বার চুড়ােয় পৌছেই মর্দানা ওঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে । ক্রুদ্ধ ফকির এবারও কাকুতি মিনতি অগ্রাহ্য করলেন , ‘ ঐ নানক নিজেকে পির বলে জাহির করে অথচ চেলার জন্য সামান্য খাবার জলও জোগাড় করতে পারে না।’বলী কান্ধারী যথেচ্ছ গালাগাল করলেন । মর্দানা নেমে এসে গুরু নানকের পায়ে প্রায় মুছিত হয়ে পড়ল । পিঠে হাত বুলিয়ে , সাহস জুগিয়ে উনি তাকে সামনের পাথরটা তুলতে বলেন । পাথরটা তােলায় তলা থেকে জলের ঝরণা বেরিয়ে এল । নিমেষেই চারিদিকে থৈ থৈ । ঠিক সেই সময় বলী কান্ধারীর জলের দরকার হয়েছে । দেখেন , কুয়ােয় একটুও জল নেই । উনি রীতিমত হতভম্ব । ওদিকে নিচে জলস্রোত দেখা দিয়েছে । বলী কান্ধারী দেখলেন , গুরুনানক দূরে বাবলাতলে অনুচরসহ বসে রয়েছেন । ক্ষিপ্ত হয়ে বলী পাথরের একখানাচাঙড়নীচে গড়িয়ে দেন । দৃশ্যটা দেখে মর্দানা চেঁচিয়ে উঠতেই গুরু নানক শান্ত স্বরে জয় নি নিরঙ্কার ’ ধ্বনি দিতে বলেন । কাছে আসতেই উনি হাত দিয়ে পাথরটা থামিয়ে দিলেন । হাসান আব্দালে এখন যার নাম ‘ পাঞ্জা সাহেব ’ , গুরু নানকের হাতের ছাপ ওতে আজও লেগে রয়েছে । গল্পটা শুনতে বেশ ভালাে লাগছিল । কিন্তু হাত দিয়ে পাথরের চাঙড় থামিয়ে দেবার ব্যাপারটা মেজাজ বিগড়ে দিল । এ কি আদৌ সম্ভব ? একটা মানুষ কিভাবে পাথরের চাঙড় থামিয়ে দেবে ? ওতে কিনা আজো হাতের ছাপ লেগে আছে । বিশ্বাস হল না , মনে হয় পরে কেউ খােদাই করেছে ’ , মা’র সঙ্গে তর্ক শুরু করি । পাথরের তলা থেকে জল বেরিয়ে আসার ব্যাপারটা মেনে নেওয়া যেতে পারে । বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জলের উৎস আবিষ্কার করা যেতে পারে । কিন্তু পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া চাঙড় হাত দিয়ে থামিয়ে দেওয়া কিছুতেই বিশ্বাস হল না । মুখের ভঙ্গিতে মনের ভাবটা ফুটে ওঠায় মা চুপকরে গেলেন । ‘ গড়িয়ে পড়া পাথর কীভাবে থামবে ? ’ গল্পটা মনে পড়লেই হাসি পেত । গল্পটা বার কয়েক গুরুদ্বারাতেও শুনেছি । কিন্তু এই ব্যাপারটাতে সবসময়েই মাথা বাঁকিয়েছি । এটা অসম্ভব । গল্পটা আমাদের স্কুলে শােনানাে হল । পাথরের ব্যাপারটা নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গেও তর্ক করলাম । যারা পারে তাদের পক্ষে মােটেই অসম্ভব না’বলে উনি আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন । তবু বিশ্বাস হল না । পাথরের চাঙড় কেউ থামাতে পারে ? আমার চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছা করত । কিছুদিন পর শুনলাম , পাঞ্জাসাহেবে ‘ সাকা’হয়েছে । সেকালে ঘনঘন ‘ সাকা ’ হত । কোথাও সাকা হলেই বুঝতে পারতাম , বাড়িতে অরন্ধন । রাতে মেঝেতে শুতে হবে । তবে সাকা আসল । | আমাদের গা থেকে পাসাহেব তেমন দূরে না । সাকার খবর পাওয়া মাত্র মা পাঞ্জাসাহেবের । দিকে রওনা দিল । সঙ্গে আমি আর আমার ছােটোখােন । সারাটা পথ ধরে মা কেঁদেছিল । সাকার । shouse সাহিত্যচর্চা । কী , তখন জানতাম না । ব্যাপারটা কী , সারাক্ষণ ধরে তাই ভাবছি । পাঞ্জাসাহেবে পোঁছে এক আশ্চর্য ঘটনার কথা জানতে পারি । দূরের শহরের ফিরিঙ্গিরা নিরস্ত্র ভারতীয়দের উপর গুলি করেছে । আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই আছে মৃতদের মধ্যে । বাকিদের অন্য শহরের জেলে পাঠানাে হচ্ছে । কয়েদিদের যদিও খিদে - তেষ্টায় সব মরার মতাে অবস্থা , তাও হুকুম হয়েছে , তাদের ট্রেন যেন কোথাও না থামে । পাঞ্জা সাহেবের লােকজন খবরটা পেয়ে সবাই উত্তেজিত । পাঞ্জা সাহেবেই গুরু নানক মর্দানার তেষ্টা মিটিয়েছিলেন । সেই শহর দিয়ে খিদে - তেষ্টায় । কাতর কয়েদিদের ট্রেনযাবে এ হতে পারেনা । ঠিক হল , ট্রেনটা থামানাে হবে । স্টেশন - মাস্টারের কাছে আবেদন জানানাে হল । টেলিফোন , টেলিগ্রাম গেল । তবু ফিরিঙ্গিদের হুকুম , কিছুতেই ট্রেনটাকে থামানাে যাবে না । এদিকে ট্রেনের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামী , দেশ - প্রেমিকরা খিদেয় । কাতর । জল , রুটির ব্যবস্থা নেই । সেখানে ট্রেন থামানাের কোন ব্যবস্থা হয় নি । তবু লােকজন ট্রেন থামাতে বদ্ধপরিকর।শহরবাসিরা তাই স্টেশনে রুটি , পায়েস , লুচি - ডাল ভঁই করে রাখে । 

কিন্তু ট্রেনটা ঝড়ের বেগে স্টেশন পেরিয়ে যাবে । কী করা যায় ?

 মায়ের বান্ধবী আমাদের সমস্ত ঘটনাটা শােনালেন , রেল লাইনে আমার ছেলেপুলের বাবা ও তারপর ওঁর সঙ্গীরা শুয়ে পড়লেন । ওঁদের পেছনে এক - একজন করে আমরা বউ ও বাচ্চারা ।। তীক্ষ্ণহুইসেল দিতে দিতে ট্রেন এল । গতি আগেইকমিয়েছে কিন্তু থামল অনেক দূরে এসে । দেখি ওর বুকের উপর দিয়ে চাকা , তারপর ওঁর সঙ্গীদের বুকের উপর দিয়ে আমি চোখ বুজলাম । চোখ খুলে দেখি ট্রেনটা একেবারে আমার মাথার কাছে এসে থেমেছে । পাশে শুয়ে থাকা সকলের বুক থেকে জয় নিরঙ্কার ধ্বনি বেরুচ্ছে । ট্রেনটা পিছােতে লাগল , লাশগুলাে কেটে দুমড়ে মুচড়ে গেল । স্বচক্ষে দেখেছি , খালপারের সেতুটির দিকে রক্তের স্রোত ।

 অবাক - বিহ্বল বসে আছি , মুখে কথা নেই । সারাদিন একফোঁটা জলও মুখে দিতে পারিনি।

 সন্ধ্যায় ফেরার পথে মা ছােটোবােনকে পাঞ্জাসাহেবের গল্প বলছিল । গুরুনানকমর্দানার সঙ্গে । কীভাবে এ রাস্তায় এসেছিলেন । তেষ্টা পেলে গুরুনানক কোন পরিস্থিতিতে তাকে বলী কান্ধারীর কাছে পাঠিয়েছিলেন।বলী কান্ধারী কীভাবে তিন - তিনবার মর্দানাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । গুরু , নানক তাকে কখন পাথর তুলতে বলেন । কীভাবে মাটি খুঁড়ে ঝরনা বেরিয়ে আসে । তাতে বলী । কান্ধারী ক্ষিপ্ত হয়ে পাথরের বড় চাঙড় গড়িয়ে দেয় । মানা ঘাবড়ে গেলেও গুরু নানক ' জয় নিরঙ্কার’বলে কীভাবে হাত দিয়ে সেটা থামিয়ে দেন । শুনতে - শুনতে ছােটোবােন মাকে বাধা । দিল , কিন্তু একটা মানুষ কীভাবে পাথরের এত বড় একটা চাঙড় থামাবে ? ” অমনি আমি বলে । উঠি , ‘ ঝড়ের বেগে ছুটে আসা ট্রেন থামানাে গেল , পাথরের চাই থামানাে যাবে না কেন ? আমার চোখে জল । কোনাে কিছুর পরােয়া না করে , জীবন তুচ্ছ করে ট্রেন থামিয়ে যারা খিদে তেষ্টায় কাতর দেশবাসীকে রুটি জল পৌঁছে দিয়েছিল , চোখের জলটা তাদের জন্য , 

অনুবাদ : অনিন্দ্য সৌরভ

Post a Comment

0 Comments